নাম দিতে পারি নাই
দেবাশিস চন্দ্র অধিকারী ২৪.০১.২০ ইং
দীর্ঘদিন পরে গ্রামে আসলে গ্রামের মানুষ তো মানুষ, গাছ গাছালিও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। ডা: ইমরানের দিকে উৎসুক জনতার তাকিয়ে থাকার আরো কারণ আছে বটে। ছেলেদের বেলায় ইংরেজি শব্দের রকম ফের আছে। বলতে হয় হ্যান্ডসাম, বিউটিফুল বলা যাবে না। ডাক্তার সাহেবের দিকে তাকিয়ে এই নিয়মের থোড়াই কেয়ার করে বহু শিক্ষিত মানুষ তাকে বিউটিফুল বলে ফেলতে দ্বিধাবোধ করেন না। এক কথায় রাজপুত্র। কিছু কিছু ক্ষেত্রে লজ্জা- শরম গ্রামের মানুষের কাছে এমনিতেই শহুরে কেতা। তাই ডাক্তার সাহেবের দিকে তাদের অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে না থাকাই বরং অস্বাভাবিক বলে মনে হত।
বিস্ময়ের উপর বিস্ময়। রাজপুত্রের পাশে বসা দেবশিশু!
ডাক্তার সাহেব পাক্কা ৫ বছর পর গ্রামের বাড়িতে এসেছেন। ছুটি ছাটায়, ইদ পরবে-পার্বনে মাস দুই-এক পর পর তার বৃদ্ধ মা-বাবাকেই আসতে হয় ঢাকার বাসায়। এবার মায়ের জেদ আর কান্না এড়াতে ব্যর্থ হয়ে বিপদে পড়েছে বাপ বেটা। উঠোন ভর্তি মানুষ। ভাত খেতে বসা মানুষের দিকে কেউ এভাবে তাকিয়ে থাকতে পারে শিশুপুত্রটির বোধগম্য হচ্ছে না।
ডাক্তার সাহেবের মা খাবার দাবারের বিশেষ আয়োজন করেছেন, তবে সুযোগের অভাবে বিরাট আয়োজন করতে পারেন নি। সেই ছোট্ট বেলা থেকেই ডাক্তার সাহেবের পছন্দ লাল শাক ভাজি, চিকন চিকন বেগুন টুকরো করে ভাজি, আলুর ভর্তা, ডারকা মাছ ভাজি আর বিরাট সাইজের রুই মাছের মাথা। ডাক্তার সাহেব বলতেন, ”মা বেহেশতে যদি আমায় খাবার দাবারের আবদার করতে বলা হয়, আমি তোমার হাতের এসব রান্না খেতে চাইব।”
বৃদ্ধ মা অনেক করেও সব জোগাড় করতে পারলেন না। সাত দিন যাবত হরতাল চলছে। বাজারে কিচ্ছু নেই। হল শুধু আলুর ভর্তা আর রুই মাছের ঝোল। অন্যান্য তরকারি সেই বিশেষ রান্নার মধ্যে পড়ে না। নিজের পুকুরে সাত বার জাল এপাশ ওপাশ টেনে সবচে বড় রুই মাছটা ধরা হয়েছে। চার পাঁচ কেজির কম হবে না বলে মাছ ধরা কাজের ছেলে ফারুকের অনুমান। ধান মাপা পাল্লা পাথর এনে দেখা গেল প্রায় সাড়ে তিন কেজি।
উৎসুক জনতাকে হমকি ধামকি দিয়ে তাড়ানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন মা। শেষে আলুর ভর্তা আর মাছের মাথা ছেলের পাতে চড়িয়ে আঁচলে চোখের জল মুছতে লাগলেন। নাতির পাতে দিলেন সবচে বড় পেটিটা। কোমল চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে কপালে আলতো করে একটা চুমু খেলেন। ভীষণ আর্দ্র হয়ে উঠল চোখ তাঁর। সইতে না পেরে ছেলের কপালেও রওনা দিলেন। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন।
ডাক্তার সাহেবের বাবা ছুটে এসে ধরলেন স্ত্রীকে।
”আহা! করছ কী! করছ কী ইমরানের মা! খেতে দিয়ে এমন কেউ করে!”
ডাক্তার সাহেব পরিস্থিতি সামলাতে বলে উঠলেন, ” মা! কান্না কাটি বন্ধ কর তো। পানি দাও। এই পানি গরম হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে টিউবওয়েল চেপে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা পানি এনে দাও।”
মা আঁচল মুখে চেপে রেখেই কলপারের দিকে রওনা দিলেন।
একটা মাত্র ছেলে তাঁর। ঢাকায় তিনি পড়তেই পাঠাবেন না। স্বামী বললেন, “এই অজপাড়াগাঁ থেকে কজন এর আগে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেয়েছে! তাও আবার ঢাকা মেডিকেলে!” এমনি মরার পড়া! সেই যে ঢাকায় পড়তে গেল! ঢাকা হয়ে গেল তার আসল বাড়ি। ছয় মাস লাগে ছেলের সিরিয়াল পেতে, এত ব্যস্ত ডাক্তার সে।
বার্ধক্যে শরীরের শক্তি ফুরিয়ে গেছে মায়ের। পুরোনো টিউবওয়েলে পানি বেরোতে চায় না। মিনিট খানেক ধরে এক জগ জল ভরলেন তিনি। জল ভরতে ভরতেই তার মনে পড়ল কত কথা! রুই মাছের মাথা ছেলের কী পছন্দ! একবার পেলে ভাতের পর ভাত খেয়েই যেত। একবার বিদেশ থেকে ভাই বেড়াতে এল তাঁর। মাছের মাথা তুলে দিলেন ভাইয়ের পাতে। আর কী হবার! ছেলে মাছের মাথার জন্য পুরো বাড়ি মাথায় করে ফেলেছিল। শেষে ভাই লজ্জায় বাঁচে না। আজ বেশিকিছু না হোক অন্তত মাছের মাথা ছেলেটার পাতে দিতে পেরে তার বুক জুড়িয়ে যাচ্ছে। আহা! ছেলেটা কতদিন পর আগের মত বাড়ির উঠোনে চট পেতে বসে বাড়ির পুকুর থেকে সদ্য তোলা মাছের মাথা খাচ্ছে। এখনও কী সে শব্দ করে মাথার ঘিলু চুষে খাবে! নাকি মানুষের লজ্জায় বা বড় হবার কারণে অমনটা আর করবে না!
একবার মাছের মাথা পেলে সময় ভুলে যেত সে। ধীরে ধীরে, সময় নিয়ে মাথা চিবুত। কাঁটার জন্য বসে থাকা বিড়ালেদের ধৈর্যের চ্যুতি না ঘটিয়ে যেন তার স্বস্তি নেই। একবার হল কী! বাড়িতে কোন একটা অনুষ্ঠান হচ্ছিল। ছেলে জানু পেতে মনের সুখে মাছের মাথা চিবুচ্ছে। একবারে যারা বসেছিল তাদের সবার খাওয়া শেষ। এখন অন্য আত্মীয়দের বসার পালা। ছেলে তখনও মাছের মাথার মধ্যে ডুবে। ছোট খালা ভাবলেন ছেলেটার বোধহয় খাওয়া শেষ। বললেন, “কীরে হাত ধোবার পানি দেব?”
ছেলে গম্ভীর সুরে হাত উঁচু করে খালাকে থামিয়ে বলে কী, “উহু! আমার এখনও খাওয়া বাকি আছে।” সবার সে কী হাসি সেদিন।
পানি আনতে আনতে আয়েশ করে ছেলের মাছের মাথা খেতে দেখার তর যেন তার সইছিল না। তড়িঘড়ি করে বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই হতভম্বের মত তাকিয়ে রইলেন মা। ছেলে তার মাছের মাথা নিজের ছেলের প্লেটে তুলে দিয়েছে। ভেঙ্গে ভেঙ্গে খাইয়ে দিচ্ছে তাকে। আয়েশ করে মাথা চিবুচ্ছে সে। হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলেন মা। বারান্দার এক কোণে কোন রকমে বসে পড়লেন।