সাইকো
প্রায় দুই বছর পেরিয়ে গেছে। কারো কোন খোঁজ খবর রাখতে পারি নাই। স্মৃতিকাতরতায় কাদের কথা বেশি মনে পড়ে? হ্যাঁ, অবশ্যই যারা ব্যতিক্রম। সেটা যেরকমই হোক। ভাল বা খারাপ। আমারও আজ তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। জানতে ইচ্ছে হচ্ছে তোর খবরাখবর ।
ও প্রায়ই বলতো, ‘দাদা, আমার সুইসাইড টেন্ডেন্সি চলছে। যা হচ্ছে, যা দেখছি, যা শুনছি এ সব কিছু মেনে নিতে পারছি না। আমার আরেকটা কাছের বন্ধু মাঝে মাঝে ওর এমন উদ্ভট কথা শুনে ও আচরণ দেখে ওকে বলতো, ‘সাইকো।’ আসলেই ও একটা ‘সাইকো’। কেন সাইকো? কারণ ও ভিন্ন ভাবে চিন্তা করতে পারতো ও করতো। ওর চিন্তাশীলতাটা গতানুগতিক ছিল না। ওর স্বপ্ন ছিল গবেষক হবে, লেখক হবে অথবা এনিমেইটেড মুভি নির্মাতা হবে। আমি অদ্ভুত হয়ে ওর স্বপ্নের কথা শুনতাম ও ওর লেখা পড়তাম।
ওর সম্পর্কে আমি এভাবে বলছি কারণ, ওকে আমি খুব কাছ থেকে জানার সুযোগ পেয়েছিলাম। কিভাবে পেয়েছিলাম আগে সেটা বলি।
তখন খুব সম্ভবত অনার্স ৪র্থ বর্ষ ৭ম সেমিস্টার চলছে। আমার বাসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের বিপরীতে চারখারপুলে। একটা রুমে ২জন থাকি। রান্না করার কোন ব্যবস্থা নেই। হলে খাই আর বাসায় ঘুমাই।
ঐ সময় ফার্মগেটে একটা কোচিং সেন্টারে ক্লাস নিতাম আর ৫টা টিউশানি করতাম। যে ৩ দিন কৌচিং এ ক্লাস নিতাম। ঐ ৩দিন শেওড়াপাড়া আর জিগাতলাতে টিউশানি করতাম।
আর বাকি ৩ দিন ক্লাস করতাম ও ঋষিকেশলেন, শাখারী বাজার ও তাঁতীবাজারে টিউশানি করতাম। এই তিন দিন দুপুরের খাবার টা প্রায়-ই ওর বাসাতেই খেতাম। মাঝে মাঝে অবশ্য নাক লজ্জাতে নিজেও বাজার করে নিয়ে যেতাম। ও থাকতো সাবলেটে। একা এক রুম। রুমের মধ্যে একটা বইয়ের সেলফ ও পড়ার চেয়ার-টেবিল। টেবিলের উপরে একটা ডেস্কটপ ও বিভিন্ন রকমের রিচার্স ও সাহিত্যের বই। বইগুলো দেখলেই আমি বিস্ময়ের চোখে তাকিয়ে থাকতাম। আর ও বলতো, ওর মায়ের কথা। ওর মা নাকি খুব বেশি দূর পর্যন্ত পড়ালেখা করার সুযোগ পায় নাই। তবে বই পড়ার প্রতি ছিল প্রবল নেশা, এমন নেশা যে, রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়তো, তখন উনি মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে বই পড়তেন।
যাই হোক, ও নিজের রান্না নিজেই করতো। বাসার রান্নার খাবারের স্বাদটা ওর রান্না থেকেই পেতাম। আমি মূলত খাবারের উদ্দ্যেশ্যেই ওর কাছে যেতাম, কিন্ত খাবার খাওয়ার আগে ও পরে ওর লেখা ও আমাকে পড়িয়ে শুনাতো, মাঝে মাঝে আমি নিজেও পড়তাম।
সাধারনের ভীড়ে কত অসাধারনত্ব। কত গভীর দর্শণ।
আজ কতগুলো মাস কেটে গেছে। কৌতুহলী মন খুবই উদ্গ্রীব হয়ে আছে ওর নতুন লেখা পড়ার জন্য। হয়তো ইতোমধ্যে ও অনেককিছুই লিখে ফেলেছে। অনেক মুভি স্ক্রিপ্ট ও কনসেপ্টও সাজিয়ে ফেলেছে। সত্য বলতে আজও আমি ক্ষুধার্ত। তবে বছর দুয়েক আগে, যে ক্ষুধা নিয়ে ওর বাসায় যেতাম। সেই ক্ষুধায় ক্ষুধার্ত না। আজ আমি ওর লেখা পড়ার ক্ষুধায় ক্ষুধার্ত।
যাই হোক, খোঁজ নিয়ে জানলাম। সেই আগের বাসায় এখন আর ও থাকে না। এখন ও মালিবাগে থাকে। কিন্ত কোথায় থাকে সুনির্দিষ্টভাবে কেঊ কিছু বলতে পারে না। বেশ কয়েকটা বন্ধুর কাছ থেকে শুনার পর, অবশেষে ওর বাসার ঠিকানা পেলাম। ফোন নাম্বারও পেয়েছি। কিন্ত সারপ্রাইজ দিব ভেবে ফোন আর করলাম না।
ঠিকানা অনুযায়ী ওর বাসায় গিয়ে উপস্থিত হলাম। গিয়ে দেখি তিন রুমের ফ্লাট। প্রতিটি রুমে দুইটি করে বেড ও দুইটি করে পড়ার চেয়ার-টেবিল। তিন রুমে ৬ জন থাকে। সবার টেবিলের উপরই বইয়ের স্তুপ। আমার বন্ধুর কথা জানতে চাইলে, একজন ওর রুম দেখিয়ে দিল। আমি ওর রুমে ঢুকতেই দেখি, আমার বন্ধু পড়ার টেবিলে গভীর মনোযোগের সাথে বই পড়ছে। মনোযোগের সাথে আমি ওকে ভাবতে দেখছি, কিন্ত এমন মনোযোগের সাথে ওকে কখনোই পড়তে দেখি নাই। ওর পাশে এসে দাঁড়ালাম আর দেখলাম টেবিল ভর্তি কেবল বই আর বই। তবে সেদিনের সেই ডেস্কটপ ও বইগুলোর নামের সাথে আজকের বইগুলোর নামের কোথাও মিল পেলাম না। আজ যা পেলাম তা হল এমপি৩, প্রফেসর আর ওরাকলের বইয়ের স্তুপ। আর আমার বন্ধু সেই স্তুপের নিচে নতজানু।