গাঁও-গ্রামে রাত আটটা না বাজতেই নিশুতি অন্ধকার নামে; বিরক্তিকর। তাই খানিকটা সময় কানে হেড-ফোন দিয়ে সিনেমাটা দেখছিলাম। একটা নতুন কালেকসন, উফঃ,শরির নাড়া দিয়ে উঠল। আর চেপে রাখতে পারছিলাম না, ফোনের চার্জও তখন প্রায় শেষ। একাই ঘরের বাইরে এলাম। পুরো বাড়িটা অচেনা, বন্ধুর নিমন্ত্রণে সেবারি প্রথম যাওয়া।

দূরে কোথাও শেয়াল ডাকছিল, দোচালা ঘরের শেষ মাথায় জাম্বুরা গাছ, চাদের আলোয় নিশ্চল পাতাগুলোর ফটোকপি উঠানের উপড়েও পড়েছিল। সেই জাম্বুরা গাছের পরে সুপারি পাতায় ঘেরা কোমড় খানিক জায়গাটাই ছোট কাজ সারার জন্যই নাকি নির্ধারিত, সাথেই ঝোপ-ঝাড়ে ঘেরা পুকুর। হঠাৎ আরেকটা শব্দ পেলাম, কেউ একজন আমার পাশেই আমার মতই দাড়িয়ে একই কাজ করছিল কিন্তু শব্দটা অনেক স্পষ্ট, আমার থেকেও বেশি সাথে তিব্র একটা গন্ধ। তাকিয়ে কে তাকে দেখার প্রবল ইচ্ছা হলেও একটা অজানা ভয় চোখের পাতায় ভর দিলো। নাহ, চারপাশে একটা জনপ্রাণীও নাই। গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠল, এমন প্রায়ই হয় আমার, ঢাকাতেও; নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম।

কয়েক মুহূর্ত পর খিক করে একটা হাসি, যেন আমাকে দেখেই কেউ একজন হাসিটা মুখ চেপে আটকাল। কে নিতিন, সৌম্য?


ঘরের দিকে হাটা দিইয়েছিলাম হঠাৎ পুকুরে ঝপ করে লাফিয়ে পরার মত শব্দ কানে এল। ফিরে দেখলাম, একটা ছেলে, ছিপছিপে, কালচে, নাঙ্গা, পানিতে ডুব দিলো; চাদের আলোয় কোমড় অবধি যতটুকু দেখা গেল। এপর্যন্ত মস্তিষ্ক শান্তই ছিল।  

গায়ের ছেলেরা রাত বিরাতে মাছ মারবে, পুকুরে নামবে এটাই তো সাভাবিক। কিন্ত জাম্বুরা গাছ এর নিচে আসতেই শরির হিম হয়ে এল। যা দেখলাম, সেই ছেলেটা মাটিতে লুটে আপ্রানে দাপাচ্ছে, নাক-মুখ দিয়ে খক খক করে পানি বের হচ্ছে, ভেজা গায়ের পানি গড়িয়ে গড়িয়ে গাছের পাতার ছায়াগুলোর মাঝখানের ফাকা স্থান বুজে দিচ্ছিল। এ মুহূর্তেই যেন আজরাইল জানটা টেনে বের করবে।    

পি-শিভার; প্যারাসিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম শরিরের রক্তচাপ কমিয়ে উরিনেশন এ ভুমিকা রাখে আবার শরির পুনরায় সেই শক্তি সঞ্চয় করে রক্ত চাপকে সাভাবিক করতে, এই পুরো প্রক্রিয়াটি শরিরে কখনও  কখনও একটা সামান্য ঝাকুনির জন্ম দিতে পারে।

আর নিজেকে সামলাতে পারি নাই, সমস্ত শক্তি দিয়ে দাড়ানোর চেষ্টা করেও মাটিতে ঢলে পরছিলাম। এর  পর যখন চোখ মেলে তাকালাম,একেবারে অন্ধকার ভোর, বোধয় ফজর এর ওয়াক্ত হয়েছে মাত্র, খালা  তাসবিহ হাতে কালেমা পড়ে ফু দিচ্ছেন। ঠিক এই কাজটা আমার আম্মাও করে। সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীজুড়ে মায়ের আচল বিছিয়ে রেখেছে। আমার পায়ের গোড়ায় ওরা তিনটা কুকুর ছানার মত গায়ে গা ভাজ করে ঘুমাচ্ছিল। খাটের পাশেই বালতিতে পানি ঢালার ব্যাবস্থাও দেখলাম, তখনও গতরাতের কথা মনে করতে পারছিলাম না কিংবা মনে তোলার সাহসও পাচ্ছিলাম না।    

খানিক পরেই খালুজান এসে সবকটা কুকুরছানার ঘুম ভাঙ্গালেন শুধু আমার মাথায় হাত রেখে বললেন বাবা তুমি আরাম করো। নূরানী চেহারার দাড়িওয়ালা মানুষটাকে খানিক ইতস্তত দেখাচ্ছিল; শুধু জিজ্ঞেস করলেন – কাল রাতে কি হইছে? ভয়ের কিছু? শরির খারাপ?

আমি আমতা আমতা করে বললাম – একটা ছেলে পুকুরে ডুবে গেল … আপনাদের বাড়ির উঠানে মারা গেছে … কি? মানে… হয়ত।      

রান্নাঘরের পাশেই জলচকি পাতা আর সেখানেই খাবারের মহা আয়োজন, খিচুড়ি, হাসের মাংস, নানান পদের ভর্তা, বকফুল ভাজি, জীবনে প্রথম এই ফুলের নাম শুনেছিলাম আর পিঠা-পায়েশ তো আছেই। সময় গড়ানোর সাথে সাথে উৎসুক গ্রামবাসীর ঢল, মহিলা, ছেলে, বৃদ্ধা সবাই আমায় দেখতে ভিড় জমাল। মৌলভি সাহেব কেও ডাকা হয়েছে। উঠানের ভিড় ঠেলে সেলিম ভাই দুইটা কিশোর ছেলেকে কান ধরে টানতে টানতে নিয়ে এলেন। উনি আমার বন্ধু মামুনদের গরুর খামার দেখাশোনা করে; ওনার চোখে মুখে ভাবটা এমন ছিল যে র‍্যাব এর বিশেষ অভিযানে গ্রেফতার আসামি ধরে আনলো।    

চাচামিয়া, এই জাউরাদুইডাই কাইল আকাম করছে। ঐ স্বীকার যা… । বলেই ধুপ ধাপ কিল হাকালেন। বাড়ির মহিলারা থামালেন।  

উপস্থিত লোকেদের কেউ আদেশ করল – যাতাপিডা কর, গাছের লগে বান্দ; গ্রামের ইজ্জত ডুবাইছে। ওদের বাপ, দাদা, মা, নানির নাম কি, কার সাথে কি বেয়াদবি করেছে, কার কি চুরি গেছে সব বিচার একে একে জমতে লাগল।  আবার কেউ কেউ উপদেশও দিলো – কবিরাজ ডেকে বাড়ি বন্ধ করো, সছদকা দাও আরো নানান কিছু।       

আমার নড়বড়ে মস্তিষ্ক মিসির আলির মত নানা যুক্তি খুজে ভয়টাকে মিথ্যে প্রমানের চেষ্টা চালাচ্ছে, যেমন পি-শিভার; প্যারাসিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম শরিরের রক্তচাপ কমিয়ে উরিনেশন এ ভুমিকা রাখে আবার শরির পুনরায় সেই শক্তি সঞ্চয় করে রক্ত চাপকে সাভাবিক করতে, এই পুরো প্রক্রিয়াটি শরিরে কখনও  কখনও একটা সামান্য ঝাকুনির জন্ম দিতে পারে। আবার হ্যালুসিনেশন, লম্বা জার্নির পর ক্লান্ত ছিলাম যা মনকেও দুর্বল করে দিইয়েছিল। তবে আমি যে যাকে দেখেছিলাম আর এখানে যে দুই ছেলেকে আনা হয়েছে তাদের দেহের গড়ন ও বয়সের তফাত বোধয় এক না। তাই হিসেব মেলে না, ঐ রাতটা কি মনের ভুল নাকি ভৌতিক?