১ সাত সকালে মোবাইল ফোনের ক্রিং ক্রিং রিংটনের আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গার মত বিরক্তিকর কাজ আর দ্বিতীয়টি নেই। এমনিতে আমি নিশাচর প্রাণীর মত। রাত জাগা ও ভোরে ঘুমোতে যাবার পুরোনো বদ অভ্যেস আমার । তারপরও আবার ফোনের আওয়াজের যন্ত্রণা। উহ অসহ্য, , , ঘুম ঘোরেই ফোনটা কেটে সাইলেন্ট করে রাখলাম।

সকাল এগারোটার দিকে চোখ খুললাম। বালিশের পাশে রাখা মোবাইল ফোনটা হাতরে বের করে , ফোনের দিকে তাকাতেই দেখি ৪৯ টি মিসড কল ও একটা টেক্সট।

টেক্সটা অন করতেই বাংলিশে লেখা তিনটি শব্দ চোখে পড়ল । শব্দ গুলো ঠিক শব্দ নয়, শব্দগুলো ছিল বন্দুকের গুলি।

‘মেহুল সুইসাইড করেছে।’

কেমন যেন ভেতর টা শুকিয়ে আসছে। অবশ ও অসাড়তা আকড়ে ধরছে। হৃদ-স্পন্দনের গতি বেড়ে গেল ও গা-হাত পা কাঁপতে শুরু করলো। এই খবরটি দিতেই আমার বন্ধু সুমন আমাকে সকাল থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছে। অথচ আমি, , , সুমনকে ফোন ব্যাক করতেই,

– কোথায় তুই? তুই দ্রুত মেহুলদের বাসায় চলে আয়।
– আচ্ছা।

মুখ থেকে শুধু একটা শব্দই বের করতে পারলাম।

পার্ট-২

আমার বন্ধু সুমন । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কাউন্সিলিং সাইকোলোজিতে স্নাতকোত্তর শেষ করেছে । স্পেশাল চাইল্ড ও মানসিকভাবে বিকারগ্রস্থ ব্যক্তিদের কাউন্সিলিং করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনাই ওর কাজ।

ওর কাছে এই কাজ কেবলই একটা প্রফেশান এমন না। ও এই কাজের মধ্যে একটা আবেগ ও ভালবাসা খুঁজে পায়। যারা স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে না বিধায় মানুসিকভাবে নিজেদেরকে গুটিয়ে রাখে ও যাদের কাছে জীবনটা অর্থহীন। তাদের মানসিকতা পরিবতর্ন করা ও জীবনটা যে আসলেই সুন্দর এমন মানুসিকতা তৈরি করার কাজটা কেবল আবেগ ও ভালবাসারই নয়, মহৎ ও বটে।

মেহুল ছিল সুমনের পেশেন্ট। মেহুল মানসিক ট্রমাতে আক্রান্ত। সাইকোলোজির ভাষায় যাকে বলে পোস্ট ট্রমাটিক ডিসঅর্ডারে ভুগছে। আগে যা যা ভাল লাগতো, এখন আর কিছুই ভাল না ওর। আগে পড়তে ভালবাসতো, এখন বই দেখলেই বইয়ের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আগে রবীন্দ্রনাথের গান পছন্দ করতো, কিন্ত এখন সেগুলো কর্কশ শোনায়। এখন জীবনটাই বড় দুর্বিসহ ও অসহ্য হয়ে উঠেছে। ওর কাছে এখন ‘মরণ তুই মম সমশ্যামা’ এমন একটা অবস্থা। জীবনের কোন অর্থই আর ও খুঁজে পাচ্ছে না।

একদিন সুমন আমাকে ফোন দিয়ে বললো ।

-আমার সাথে একটু দেখা করতে পারবি ?

কোন কিছু না বলেই হুট করে ওর সাথে দেখা করার কথা বলার ধরনে আমি বেশ বুঝতে পারলাম, গুরুত্বপূর্ণ কিছু। তাই কথা না বাড়িয়ে বললাম,

– আচ্ছা ঠিক আছে, রাতে দেখা করবো।

পার্ট-৩

রাতে সুমনের সাথে দেখা করতে ওর বাসায় গেলাম। বাসায় ঢুকতেই জিজ্ঞাসা করলো,

– কফি?

– ঠিক আছে।

এত সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর কখনোই আমাদের কোন বন্ধুরই ওর সাথে হয় না। আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম,

– সুমন, তোর কি হয়েছে? এনিথিং রোং ?

– আমি ঠিক আছি, তবে , , ,

– তবে কি ?

– মেহুল,

– মেহুল, সে কে?

– আমার নতুন পেশেন্ট । ওর সমস্যাটা একটু জটিল।

– কেন, কি হয়েছে?

প্রায় এক সপ্তাহ আগের একটা সংবাদপত্র আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

– এই খবরটি পড়েছিস?

– না,

– পড় , সব বুঝতে পারবি।

শিরনামে দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিলাম শুধু মূলভাবটা বুঝার জন্য। আর তখন ও বলতে শুরু করলো।

– আসলে মেয়েটি কারু সাথে কোন কথা-ই বলছে না। যদি ও কথাই না বলে তবে আমি কি করে কি করবো ঠিক বুঝতেই পারছি না।

– হুম,

– তুই আমাকে একটু হেল্প করতে পারবি ?

– এ ক্ষেত্রে, আমি কিভাবে সাহায্য করতে পারি?

– তুই কোন প্রশ্ন করিস না, প্লিজ। আমি যেভাবে যেভাবে বলি তুই শুধু সেভাবে হেল্প করবি। তোর এই হেল্পে যদি একটা মেয়ের জীবন ফিরে পায়! স্বাভাবিক হয়! সো, প্লিজ।

– আচ্ছা, ঠিক আছে ।

পরের দিন মেহুলের বাবার কাছ থেকে জানতে পারলাম মেহুলের একটা কাছের বান্ধবি ছিল। নাম সোমা। সোমার বাসা মেহুলদের বাসার পাশেই। আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল মেহুলের সাথে দেখা করতে কিন্ত সুমনের নির্দেশ অনুযায়ী আমরা সোমার বাসার উদ্দ্যেশ্যে রওনা হই।

যথারীতি সোমার বাসায় এসে উপস্থিত। সোমা প্রথমে একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিল । ও ভেবেছিল আমরা পুলিশের লোক। কিন্ত আমাদের পরিচয় পেয়ে ও একটু আশ্বস্থ হয়। তারপর সুমন ওকে প্রশ্ন করতে শুরু করল,

– মেহুলের সাথে আপনার পরিচয় কতদিনের ?

– কলেজ লাইফ থেকে,

– এখন ?

– মাইন্ড করবেন না, প্লিজ। আসলে বাবা-মা চায় না যে ওর সাথে আমি কোন যোগাযোগ রাখি।

আমার খুব ইচ্ছে হল ওদের কথোপকথনের মাঝে একটা প্রশ্ন করি,

-ওর অপরাধ ?

কিন্ত নিজেকে সংযত করে নিলাম। পরক্ষণেই সুমন বলল,

– আপনার জানা মতে আপনি ছাড়া আর কার কার সাথে ও ক্লোজলি মিশত?




– আসলে ও একটু ইন্ট্রোভার্ট স্বভাবের। সবার সাথেই সমান ভাবে মিশত। কারুর সাথেই তেমন ঘনিষ্টভাবে মিশত না। তবে, এক সিনিয়ার বড় দাদা ওকে খুব পছন্দ করতো। মেহুল ও পরবর্তীতে ঐ দাদাকে ভালবেসে ফেলে। কিন্ত, এই সব কিছুই গোপনে ।

– গোপনে কেন ? এবার আমি প্রশ্ন না করে থাকতে পারলাম না।

– আসলে অনিমেষ দা ছিল খুবই মেধাবী ও ক্যারিয়ার সম্পর্কে সচেতন একজন ব্যক্তি। যদিও মেহুল তেমন মেধাবি ছিল না কিন্ত ওর পড়ালেখার প্রতি তীব্র আগ্রহ ও সহজ-সরল স্বভাব দেখে দাদা তাকে পছন্দ করে। উপযাচক হয়ে দাদা নিজেই মেহুলকে অনেক সাহায্য করতো ও পরামর্শ দিত। কিভাবে ভাল রেজাল্ট করা যায়, জীবনে লক্ষ্যে পৌছাতে কি কি করতে হয়, আর কি কি বিসর্জন দিতে হয় ইত্যাদি। এবং একটা সময় মেহুল ও অনিমেষ দাদার প্রতি দূর্বল হয়ে পড়ে। এবং তারা দুজন মিলে একটা ভবিষৎ গড়ার স্বপ্ন দেখতে থাকে।

– এতে সম্পর্কের কথা গোপন রাখার কি আছে ?

– অনিমেষ দা খুবই ভদ্র স্বভাবের। বিশ্ববিদ্যালয় তথা বিভাগে তার ভদ্রতার জন্য যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। তাই সে কখনোই মেহুলের সাথে প্রকাশ্যে দেখা করা বা কথা বলতো না, পাছে যদি তার নামের পাশে কোন দুর্নামের দাগ লাগে এই ভয়ে।

ভালবাসার কথা জানাজানি হলে দূর্নাম হয় । জীবনের প্রথম এমন কথা শুনে অবাকই লাগলো । জানি না আরো কত অবাক করা তথ্য জানতে পারবো। আমরা আর সোমার বাসায় কালক্ষেপণ করলাম না।

পার্ট-৪

মেহুলের ভার্সিটি থেকে অনিমেষের বাসার ঠিকানা নিয়ে অনিমেষের বাসার উদ্দ্যেশ্যে রওনা হলাম। পথের মাঝে সুমনকে শুধু একটি প্রশ্নই করেছিলাম।

– আমরা কেন সোমা, অনিমেষ এদের সাথে কথা বলছি ?

– যেহেতু, মেহুল কিছু বলছে না। তাই কিছু একটা বের করতে চাইছি যাতে মেহুল আমাদের সাথে অন্তত কথাটুকু বলে।

আমি আর কিছুই বললাম না। সোজা অনিমেষের বাসায় চলে আসলাম। বাসার কলিং বেল চাপতেই এক বয়স্ক লোক দরজা খুলে দিয়ে জানতে চাইলো আমরা কে? কেন এসেছি?

সুমন আমাদের পরিচয় ও আসার কারণ জানালো। ভদ্রলোক অনিমেষের বাবা পরিচয় দিয়ে , অনিমেষের ঘর দেখিয়ে দিল। অনিমেষ বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। অতি ভদ্র ছেলে। বাবা মায়ের বাধ্যনুগত । সারাদিন বই আর পড়ালেখা নিয়েই ব্যস্ত। বাবা মায়ের স্বপ্ন অনিমেষ বিসিএস ক্যাডার হবে। সেই স্বপ্ন পূরণের জন্যই ওর এত পরিশ্রম।

রুমে ঢুকেই সুমন আমাদের পরিচয় ও আসার কারণ অনিমেষের কাছেও জানিয়ে প্রশ্ন শুরু করলো।

– আমি কি মেহুল সম্পর্কে আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে পারি?

– জ্বি, করুন।

– আপনি ওকে কিভাবে চেনেন, কতদিন ধরে চেনেন?

– দেখুন, আমরা একই ভার্সিটিতে , একই বিভাগে পড়ি। ও পড়ছে অর্নাস ৬ষ্ঠ সেমিস্টারে আর আমি মাস্টার্স ২য় সেমিস্টারে। আমি ওকে প্রথমে আমাদের বিভাগেই দেখি। পরে মাঝে মাঝে লাইব্রেরী ও ক্যান্টিনেও । আর পরিচয়? আমি ওকে প্রায় তিন বছর ধরে চিনি।

– আপনি কি ওকে শুধুই চেনেনই, নাকি জানেনও?

কথার মাঝে হুট করে প্রশ্ন করে বসলাম।

– জানা বলতে, মেহুলকে আমার ভাল লাগতো।

– কেন ভাল লাগতো, জানতে পারি কি?

এবার আমিই প্রশ্ন করতে লাগলাম। এই অনিমেষের সাথে কথা বলতে এসে কেন যেন মনে হচ্ছিল। মেহুল আমারই পেশেন্ট । সুমনই আমার সাথে আছে এবং সুমনই আমাকে সাহায্য করতে এসেছে।

– আসলে আমি ওকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম।

– আপনি কি ওকে ভালবাসেন?

– একচ্যুয়েলি, বর্তমান যুগে প্রেম, ভালবাসা বলতে যেরকম টা বোঝায় । আমাদের মধ্যে সে রকম কোন সম্পর্কই ছিল না। আমি ভেবেছিলাম যদি আমি ওকে বিয়ে করি, তবে আমরা দুজনেই ভাল থাকবো।

– এ রকমটা কেন ভেবেছিলেন?

– মেহুল আসলেই অনেক ভাল একটা মেয়ে। ওর ভাল একটা মন আছে। ও কেইয়ারিং । ও খুব যে মেধাবী এমন না, তবে চেষ্টা ওর আছে। আগ্রহ আছে। এক কথায় ও সংবেদনশীল। তাই চেয়েছিলাম।

– চেয়েছিলেন কিন্ত এখন?

– সরি টু স্যা, আমার বাবা-মা মেনে নিবে না। উনারা এত কষ্ট করে আমাকে মানুষ করছে। আমি উনাদের মনে আঘাত দিতে পারবো না।

অনিমেষের সাথে কথা বলে খুব রাগ হচ্ছিল। কিন্ত রাগটাকে নিজের মধ্যেই মেঘে ঢাকা তারার মত করে ঢেকে রেখে দিলাম। সুমন অবশ্য বুঝে ফেলেছে যে আমি খুব রেগে গেছি, তাই আমরা আর অনিমেষের সাথে কথা না বাড়িয়ে বিদায় নিলাম।

পার্ট-৫

অনিমেষের সাথে কথা বলার পর থেকে মেহুলের বিষয়ে কৌতুহলের মাত্রাটা কেমন যেন একটু বেশিই গভীর হতে শুরু করল। কেমন যেন ভাবনার দরজায় অনেক গুলো প্রশ্ন কড়া নাড়তে শুরু করেছে।

আর এখন আমি সুমনকেই প্রশ্ন করতে শুরু করলাম।

– আচ্ছা, মেহুল কি বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে?

– না, ওর একটা বড় দাদা আছে।

– কোথায়, ওর বাবার সাথে তো আমরা অনেক ক্ষণই কথা বললাম। তাকে যে বাসায় দেখলাম না ?

– দাদার স্ত্রী পেশায় বেসরকারী একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক। মেহুলের জন্যে নাকি তারা মানুষ সমাজে মুখ দেখাতে পারছে না। তাই এই বাসা ছেড়ে অন্যত্র বাসা নিয়েছে।

আমি অবাক দৃষ্টিতে সুমনের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলাম।

– তাই, দাদা বোনকে এভাবে রেখে ????

– মাঝে মাঝে গোপনে এসে দেখে যায়।

আর কোন প্রশ্ন করতে পারলাম না। কেমন যেন নিজের ভেতরে প্রশ্নেরা জট পাকাতে শুরু করছে। আমি স্তব্ধ হয়ে ভাবতে থাকলাম। সুমন ও স্তব্ধ।

মানুষ জানে পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণীর মত তার মৃত্যু ও অনিবার্য। তারপরও, মৃত্যুর সময় কয়েকটা স্নেহকাতর চোখ ও মুখকে দেখে মৃত্যুবরণেও এক ধরণের পরিতৃপ্তি রয়েছে।

পার্ট-৬

রাত জাগাটা আমার অনেক পুরোনো অভ্যেস। হয় বই পড়ে অথবা মুভি দেখে। কিন্ত সম্প্রতি বই পড়া ও মুভি দেখায় কোনটাতেই মনোযোগ দিতে পারছি না। মেহুলের সমস্যাটা যেন আমার ব্যক্তিগত চিন্তাতে ঢুকে পড়েছে।মাথার মধ্যে কেমন যেন একটা চিন্তা রোগ বাসা বেধে নিয়েছে।

মেহুল বর্মণ বাবা-মায়ের বড় আদরের ছোট মেয়ে। মধ্যবিত্ত পরিবার। বাবা পেশায় ব্যবসায়ী। দাদা ব্যাংকার। বৌদি বেসরকারি একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক। রাজধানীর বুকে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ণরত। বিষয় ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যা। ৬ষ্ট সেমিস্টার ৩য় বর্ষ । খুব যে মেধাবী এমন না, তবে মেধার তুলনায় চেষ্টাটা বেশি। শান্ত স্বভাবের, অর্ন্তমুখী ও কেয়ারিং । সব চেয়ে বড় কথা ওর ভাল একটা মন আছে।

কয়েক দিনের সংগৃহিত তথ্যগুলো মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। সবচেয়ে তালগোল পাকাচ্ছে ওর ভালবাসার মানুষের দেওয়া ‘ওর ভাল একটা মন আছে’ তথ্যটি জেনে। অনিমেষ ওকে জেনেছে, বুঝেছে। সর্বোপরি ভাল বলছে। অথচ তাকে সে গ্রহণ করতে নারাজ।

একমাত্র কাছের বান্ধবী সেও আজ দূরের। দাদার কাছেও স্ত্রীর তথাকথিত স্ট্যাটাসটা-ই বড় হয়ে গেল।

মা কেবলই কাঁদছে। আর বাবাটা হতাশায় দিশেহারা।

একটি বিছিন্ন ঘটনা। তার দায় ভার সকলে মিলে কেন নির্দ্বোষ মেয়েটার উপরে চাপিয়ে দিচ্ছে? এই ভার যে একটু বেশিই ভারী। এত বেশি ভার একলা একটা মেয়ে কি করে বইবে ?

দু’দিন আগেও আমি মেয়েটার স্তবধতাকে আদিখ্যেতা ভেবেছি। অথচ এখন মনে হচ্ছে , মেহুলই ঠিক আছে। শুধু বোবা নয়, ওর অন্ধ হয়ে যাওয়া উচিৎ। ওর বধিরও হয়ে যাওয়া উচিত।

কিন্ত আমরা? আমাদের কি কিছুই করা উচিৎ না? মানবিক দিক থেকে হলেও তো আমাদের কিছু করা উচিৎ!!!

নিজের সাথে নিজের কথোপকথনে নিজেই ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি। কথোপকথনের সমাপনী এই যে , কাউকে না কাউকে ওর পাশে দাঁড়াতেই হবে। কিন্ত কে দাঁড়াবে? কে ?

হ্যাঁ, আমার কাছে সুমনের চাওয়া হেল্প টা যে কি ছিল , সেটা এবার ক্লিয়ার হল। সেটা বুঝতে আর বাকি রইল না।

পার্ট-৭

সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। আমিই থাকবো মেহুলের পাশে। কিন্ত করুনা বা সহানুভুতি নিয়ে যে কারো পাশে থাকা যায় না। করুনা বা সহানুভূতি নিয়ে কারো কাছে থাকা গেলেও, পাশে থাকার জন্য চাই ভালবাসা। কিন্ত ওকে তো আমি ভালবাসি না। ওর প্রতি যে অনুভুতির জন্ম হয়েছে তা কেবলই এক অসহায় মেয়ের প্রতি সহানুভুতি। এই সহানুভুতি নিয়ে পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতিও যে এক প্রকার প্রতারণা।

তবে কি আমি প্রতারনার আশ্রয় নিতে যাচ্ছি? নিলামই না হয় প্রতারণার আশ্রয়, কিন্ত জীবন বাঁচাতে প্রতারনার আশ্রয় নাকি কৌতুহল মেটাতে প্রতারনার আশ্রয় এই দুই প্রত্যয়ের মাঝে যুদ্ধ শুরু হল। আর সে যুদ্ধে আহত আমি।

যাই হোক, রাতে আর ঘুমই হল না। পরের দিন আমিই সুমনকে ফোন করে মেহুলদের বাসায় যাই।

ড্রয়িং রুমে মেহুলের বাবা-মা, সুমন আর আমি। পাশের রুমে মেহুল গৃহবন্ধি। আমার খুব ইচ্ছে ওর সাথে একবার দেখা করবার। কিন্ত, ও কারু সাথেই দেখা করে না, কথা বলে না। অবশেষে, সাহস করে মেহুলের বাবাকে বলেই ফেললাম,

– আংকেল, আমি কি ওকে একটু দেখতে পারি ?

মেহুলের বাবা স্তব্ধ। সুমনের ঘাড় নাড়ার হ্যাঁ সূচক ইশারায় উনার বাবা আমাকে সম্মতি দিল।

আমি এসে দাঁড়ালাম মেহুলের রুমের দরজার সামনে। দরজায় বারবার কড়া নাড়ছি। কিন্ত ও পাশ থেকে কোনই সাড়া শব্দ নেই। ওপাশে একেবারেই স্তব্ধ।

পার্ট-৮

মেহুলদের বাড়িতে আজ প্রায় সবাই এসেছে। সবাই আজ শোকার্ত। শোক প্রকাশ করাটাও যেন এক প্রকার সামাজিকতা রক্ষা, হয়তো সে কারনেই এসেছে। এবং সবাই কাঁদছে। না কাঁদলে লোকজনের সমালোচনার শিকার হতে হবে। এই সমালোচনার ভয়, মান সম্মান নষ্ট হবার ভয় বড্ড বেশিই বড় ভয়। তাদের চোখের জল কততুকু হৃদয়ের আর্তনাদ থেকে আর কতটুকু লোক দেখানোর সেটা পরিমাপ করার কোন নিক্তি আমার কাছে ছিল না।

সোমা, অনিমেষ, দাদা ও বৌদি সবার চোখেই আজ জল। সবাই-ই কাঁদছে। আমি কেবল সবাইকেই দেখছিলাম। কিন্ত আমি নিজে কান্না করতে পারছি না। নিজের মধ্যে নিজের প্রতি একটা অপরাধ বোধ কাজ করছে।

মানুষ সত্য কিন্ত সত্য মানুষের চেয়েও গভীর। মেহুলের মৃত্যুটা সত্য , কিন্ত এর চেয়েও গভীর একটা সত্য আছে , সেটা হল তার মৃত্যুর কারন।

একটা অনাকাক্ষিত ঘটনায় ও স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। তবে সে ঐ ঘটনা ঘটার পর পরই মারা যায়নি। বেঁচে ছিল। সুতরাং সরাসরি ঐ ঘটনাকে দায়ি করা সমীচীন হবে না।

সবার ধারণা এর কারণ স্বয়ং আমি-ই অথবা আমি-ই জানি। কারণ মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত ও কেবল আমার সাথেই দেখা করেছে, অন্য কারো সাথে না। যদিও তার মুখের ভাষা বরাবরই ছিল না, তবুও কারণটা আমার জানা। কিন্ত আমার ধারণা ও ভাবনা অন্য কিছুতে।।

পার্ট-৯

মানুষ কোন পরিস্থিতিতে আসলে জীবনের চেয়ে মৃত্যুকেই বেশি আপন করে নেয়?

মানুষ জানে পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণীর মত তার মৃত্যু ও অনিবার্য। তারপরও, মৃত্যুর সময় কয়েকটা স্নেহকাতর চোখ ও মুখকে দেখে মৃত্যুবরণেও এক ধরণের পরিতৃপ্তি রয়েছে। কে-ই বা চায় তৃপ্তিহীনতায় নিজেকে স্বেচ্ছায় নিঃশেষ করতে।

মেহুল কেন আত্মহত্যা করলো? আর কেনই বা এতদিন স্তব্ধ হয়ে বেচে ছিল? এখন এই দুটি প্রশ্নের মুখোমুখি আমি। এই দুটি প্রশ্ন কেবল মেহুলের বাবা ও মায়ের নয়, বরং সবার।

প্রথম প্রশ্নের উত্তর হল,

মেহুল কোন বখাটেদের দ্বারা ধর্ষিত হয় নি।মেহুল ধর্ষিত হয়েছিল থানায় পুলিশের দৃষ্টিতে, চাহিনিতে। ফলে, অভিযোগ তো করতেই পারেনি, বরং স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। রক্ষকের দৃষ্টি যদি ,,,,,

সাংবাদিকদের প্রশ্নে ও ভাষায়। অতঃপর সত্যতা না জেনেই সংবাদপত্রে ধর্ষণের খবর ছাপানোতে

মেহুল ধর্ষিত হয়েছিল সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরালে। বন্ধু-বান্ধবীদের কাছে একটা বাজে ভাষার আলোচনার পাত্রী হওয়াতে।

মেহুল মর্মাহত হয়েছিল বাসায় আসার পর পরই বৌদির সিনক্রেইট ও দাদাকে নিয়ে বাসা ছেড়ে চলে যাওয়াতে।

মেহুল বেচে থাকার আশা ছেড়ে দিয়েছিল, যখন ও নিজের কানেই বাবা মা’য়ের হৃদয় ভাঙার আর্তনাদ শুনে।যখন অনিমেষ তাকে ছেড়ে দেয়। সোমা ও তার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। যখন সে অনুভব করে পথের মানুষের দৃষ্টিতে মিশে আছে একটা সংকেত, একটা বাজে সংকেত।

মেহুল কেনই বা এতদিন স্তব্ধ হয়ে বেচে ছিল?

উত্তরঃ অপেক্ষায়?

ও অপেক্ষা করছিল যে, এই পৃথিবীর অন্তত একজন হলেও,তাকে বুঝুক। এতে তার কি অপরাধ? অন্তত একজন সত্যিকারের ভালবাসে দু’ফোটা অশ্রু ঝরাক। অন্তত, একজন জানুক বখাটেদের থেকে সে নিজেকে বাচাতে পারলেও, এই সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির কাছ থেকে সে বাচতে পারে নাই। অতপর অন্তত একজনের কাছে ও ওর অস্তিস্ত্বকে বাচিয়ে রাখতে চেয়েছিল।

হয়তো মেহুল ভেবেছিল সেই একজনকে ও পেয়ে গিছে। তাই আর নিজেকে বাচিয়ে রাখলো না, পোড়ামুখী।

যাই হোক, মেহুলের কাছে এ পর্যন্ত আমি কেবল একটি প্রশ্নই করেছিলাম।

– I am sure, you are not raped.

টেবিলের উপর রাখা খাতাতে লিখে ও এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিল।

– Yes, I am not raped physically by any miscreant but I am raped psychologically by the society.

মানুষ কখনো শরীরের আঘাতে আত্মহত্যা করে না, মানুষ আত্মহত্যা করে মনের আঘাতে। যে যত বেশি সংবেদনশীল, সে মনে মনে তত বেশি আঘাত প্রাপ্ত হয়।

মেহুল নরপিশাচদের দ্বারা শারীরিকভাবে ধর্ষিত না হলেও, এই সমাজের দ্বারা মানুসিকভাবে সে ধর্ষিত যেটা সে মেনে নিতে পারেনি।

কিন্ত মেহুল তো কোন কথা-ই বলত না, তাহলে আমি বুঝলাম ও প্রশ্ন-ই বা করলাম কিভাবে?

তবে কি আমার সহানুভূতি ভালবাসায় পরিনত হয়েছিল!!!