এডজাস্টমেন্ট

অবশেষে বিয়ের সম্মতি পাওয়া গেলেও, একটা খটকা রয়েই গেল। মা যে মেয়েকে পছন্দ করবে, সেই মেয়েকেই ছেলে বিয়ে করবে। এরকম কথা শুনে মেয়ে পক্ষের মধ্যে দুইটি গ্রুপ তৈরী হয়ে গেল। এক পক্ষের মন্তব্য, ছেলে কতই না ভাল! এই আধুনিক যুগে প্রায় ছেলেই যেখানে প্রেম-ভালবাসা করে বিয়ে করছে, আর এই ছেলের কাছে মায়ের পছন্দই তার পছন্দ। কি মাতৃভক্তি!

আরেকপক্ষ মন্তব্য করছে, ছেলের সমস্যা আছে। দ্যাখো গিয়ে, কোথায় কি অঘটন ঘটিয়ে রেখেছে কিনা।
ছেলে অবিচল। মায়ের জন্য সে বিয়েতে মত দিয়েছে। অন্যথায় বিয়েতে তার বিশেষ কোন আগ্রহ নেই। সুতরাং, মেয়ে পছন্দ করার দায়ভার ও মায়ের-ই, , , , ,

ছেলে পক্ষের মধ্যেও দুইটি গ্রুপ তৈরী হয়ে গেল। এক পক্ষ মায়ের পছন্দ হয় এমন মেয়ে খুঁজতে শুরু করলো। আরেক পক্ষ ছেলেকে বুঝাতে শুরু করলো,
– যার সাথে আজীবন একত্রে এক ছাদের তলায় কাটাবি, তাকে না দেখে, না জেনে ও না বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া কতটুকু সমীচীন?
একরোখা ছেলেটার একটাই কথা,
– বিয়েটা নিজের জন্য করছি না, কেবলই মায়ের জন্য। ছেলেকে বিয়ে দেওয়া মায়ের কর্তব্য, তাই মাকে এই কর্তব্য পূরণের সহায়তা করছি মাত্র।
এর পর আর কেউ কোন কথা বলেনি। ছেলেটাও স্বাভাবিক।

মিহির পাইক। সরকারী ব্যাংকের কর্মকর্তা। অতিব নিরীহ প্রকৃতির সহজ সরল একজন মানুষ। বাবা নেই। একমাত্র মা। অবসর সময়ে বই পড়তে ভালবাসে। ভার্সিটি লাইফে এক বান্ধবির ছোট বোনকে খুব পছন্দ করতো। কিন্ত মুখ ফুটে তাকে কখনো কিছু বলতে পারেনি । বিশ্বস্ত এক মাধ্যম দিয়ে তার কাছে প্রস্তাব পাঠানো হলে, এক প্রকার অপমানিত-ই হোন তিনি। গায়ের রং কালো বলে। তারপর থেকে আর কোন মেয়ের দিকেই তার ওভাবে তাকানো হয়ে উঠেনি ।
এখন মায়ের একটাই চাওয়া। মৃত্যুর আগে ছেলের বৌয়ের মুখটা দেখে যাওয়া। মায়ের ইচ্ছে পূরণ করতেই তার এই বিয়েতে সম্মতি।

অবশেষে পাত্রী পাওয়া গেল, বিয়ের দিন ও ধার্য হল। সন্ধ্যা মালতী। অতীব সুন্দরী । দুধে আলতা গায়ের রং। হরিণ কালো চোখ। মেঘের মত কেশ। ছিপছিপে কটি ও দোহারা গড়ণ। পাত্রী খুঁজতে বেশি কষ্ট হয়নি। দুই-তিনটি মেয়ে দেখতে হয়েছে মাত্র। তাদের মধ্যে যে মেয়েটিকে মা পছন্দ করেছে ,সেই মেয়ের সাথেই বিয়ের দিন ধার্য করা হয়েছে।

আসলে আমাদের দেশে সুন্দর মানসিকতা অপেক্ষা গায়ের রং গুরুত্বপূর্ণ, আবার গায়ের রং অপেক্ষা সরকারী চাকুরী গুরুত্বপূর্ণ। তাই মিহির পাইকদের সুন্দর মানুসিকতা ঢাকা পড়ে রয়, তাদের গায়ের কালো রঙ্গে ও সরকারি চাকুরীর আবরনে।

যাই হোক, সন্ধ্যা মালতীর রুপের প্রশংসা সবার মুখে মুখে । এতে মিহিরের তেমন কোনই আগ্রহ নেই। মিহিরের কাছে বিয়েটা কেবলই একটা প্রথা। আর সেই প্রথা পালনেরই প্রস্তুতি নিচ্ছে সে। মজার বিষয় এই যে, আজো পর্যন্ত ছেলে মেয়ের বা মেয়ে ছেলের কোন ফোটো পর্যন্ত দেখেনি। সরাসরি দেখা করার কথা না হয়, বাদই দিলাম। হ্যা, তবে মোবাইল ফোনে মাঝে মাঝে কথা হয়েছে।

অবশেষে, বিয়ের দিন এল। বর বেশে মিহির পাইককে ভালই লাগছে। কালো রঙ্গে সোনালী রঙ্গের ধূতি-পাঞ্জাবী ও ময়ূরী মুকুট।
আর সন্ধ্যা মালতীর চিকন গৌড় মুখে ও কপালে বিয়ের চন্দন। লাল বেনারশী শাড়িতে এক অপরুপা।

রাত ১ঃ০৫ মিনিটে বিয়ের লগ্ন। চারটি কলাগাছের মাঝে দুটি আলপনা করা পিড়ি। চারিদিকে মানুষের বৃত্তাকার বেষ্টন। ঢাকের আওয়াজ ও পুরোহিতের সাথে সাথে মিহিরের মন্ত্র পাঠ। এক সময় সন্ধ্যা মালতীর হাতে, মিহিরের হাত।

ঠিক এমন মূহুর্তে মিহিরের প্রথার দরজায় যেন কোন অচেনা কেউ কড়া নাড়লো, মিহির শান্ত হয়ে গেল। কেবল মুখস্ত কবিতার মত পুরোহিতের সমস্বরে মন্ত্র পাঠ করে চললো। কিন্ত এই মন্ত্র তার হৃদয়ে স্পর্শ করেছিল কিনা তা জানি না।
ওপাশে সন্ধ্যামালতিরও চেহারার মাঝে কেমন যেন একটু মলিনতা, একটু বিষন্নতা ও একটু বিমর্ষতা।

সন্ধ্যামালতির হাতে মিহিরের হাত, কিন্ত মিহিরের অনুভুতিতে অন্য কিছু, অন্য কারুর হাত। তবে সন্ধ্যা মালতী স্তব্ধ, নিথর। বিমর্ষ বটে কিন্ত অনুভুতি শূন্য।
মানুষের মধ্যে জীবনের অস্তিত্ব নাকি অনুভূতিতেই বিদ্যমান। আর সেই অনুভূতি যদি শূন্য থাকে তবে জীবনের অস্তিত্ব কোথায় থাকতে পারে?
যাই হোক, হত দরিদ্র এক ছেলেকে ভালবেসেছিল সন্ধ্যামালতী। দীর্ঘ সাত বছরের সম্পর্ক। এত দিনের সম্পর্ককে ঠিক ভালবাসা বা প্রেম নামে আখ্যায়িত করলে ছোট করা হয়। বরং বলতে হবে দীর্ঘ সাত বছরের সংসার তাদের। কারণ, আমার মতে বিয়ের জন্য মন্ত্রের থেকে, দুটি মনের মিলন-ই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেই দিক থেকে তাদের সাত বছরের মনের মিলনকে, সাত বছরের সংসার বলতেই পারি। আর সেই সংসারকে রেখে,অন্য আরেক ঘরে আজ প্রদীপ হয়ে এসেছে, ঘরকে আলোকিত করতে। এক ঘরে অন্ধকার, আরেক ঘরে আলো। অনুভূতি নামের ধারাপাতে এমনই করে বুঝি শূন্য নামের সংখ্যা চিনতে হয়!

অনুভূতির যা-ই হোক না কেন, বিয়ে হয়ে গেল। উভয়ের সম্মতিতেই বিয়ে হল। বিয়ের যত প্রকার আনুষ্টানিকতা সব-ই সুন্দর ভাবেই শেষ হল । শুধু বাকি রইল স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ‘এডজাস্টমেন্ট’।

মন্ত্রে মিহির ও সন্ধ্যামালতী স্বামী- স্ত্রী, কিন্ত মনের দিক থেকে যে কি সেটার নামকরণ এখনো করতে পারছি না। কারণ, মিহিরের ভেতরে অধিকার-অনধিকারের যে দ্বন্দ্ব চলছে, সন্ধ্যামালতির মধ্যে তার চেয়েও ঢেড় বেশি দ্বন্দ্ব বিরাজমান।
চাই এডজাস্টমেন্ট। নিজেদের জন্য না হলেও। দুই পরিবারের জন্য। এডজাস্টমেন্ট ছাড়া বিকল্প আর কি-ই বা থাকতে পারে।
মিহির নিজেকে বুঝাতে শুরু করলো,

‘এ পৃথিবীর খুব কম সংখ্যক মানুষই আছে যারা ভালবাসার মানুষকে জীবন সাথী হিসেবে পেয়েছে। আর আমি তো চেষ্টা করেছি, যার জন্য হয়েছি লাঞ্জিত, অপমানিত। আমি যেমনই থাকি না কেন, সে হয়তো সুখেই আছে। ভালই আছে।’

সন্ধ্যামালতিও নিজেকে বুঝালো এই ভেবে যে,
‘ তাকে অনেক সময় দিয়েছি। আর কত? নিজেকে প্রতিষ্টিতই করতে পারলো না। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা হেরে যায় এক ভালবাসার কাছে। আবার ভালবাসা হেরে যায় সেই মৌলিক চাহিদাগুলোর কাছে। এমন নয় যে, স্ট্যাটাসটা প্রভেদ। আমি না হয়, relative poverty কে উপেক্ষা করলাম, কিন্ত, absolute poverty কে কিভাবে উপেক্ষা করি ? সে ও পারলো না , আর আমিও না।

যাই হোক, দু’জনই দু’জনের কাছে দু’জনকে জানালো। উদ্দ্যেশ্য একটাই এডজাস্টমেন্ট।

এই এডজাস্টমেন্টেই চলেছে সংসার। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবার সাথেই বেশ আন্তরিকতা, আনুষ্টিকতা ইত্যাদি।

এভাবেই প্রায় ২ বছর কেটে গেল। মালতী মা হতে চলেছে। মালতী মনে মনে কন্যা সন্তান কামনা করছে। ও ভাবছে,
– আমার মেয়েকে এমন ভাবে প্রতিষ্টিত করবো যাতে ওর ভালবাসাকে ও নিজেই জয় করতে পারে।
কিন্ত মিহির ভাবছে এর উল্টো,
-আমার ছেলে যেন কালো না হয়।’

About Author /

Start typing and press Enter to search

You cannot copy content of this page