পার্ট-১

গ্রামের প্রায় সব মানুষ-ই অবাক। এমন আমূল পরিবর্তন! অকল্পনীয়। যিনি সব কিছুতেই আমার আমার মনে করতে অভ্যস্ত ছিলেন, সম্প্রতি তিনি আর কোন কিছুই নিজের মনে করেন না। এই কিছু দিন আগেও যিনি ছিলেন উদ্ধত,এখন তিনি নম্র, যিনি ছিলেন অহংকারী, এখন তিনি বিনয়ী, যিনি ছিলেন রাগী, এখন তিনি শান্ত স্বভাবের। যিনি কখনোই সত্য বলতেন না, এখন একটা ও মিথ্যে বলেন না, যিনি ছিলেন জটিল, এখন তিনি সরল। যাকে সবাই ভয় পেতো, এখন প্রায় সবাই-ই তাকে ভালবাসে ও শ্রদ্ধা করে।

তিনি আগেও গ্রামের শালিশ বা বিচারের প্রধান ছিলেন, এখনো তিনি-ই প্রধাণ। আগের শালিশ বা বিচারের দন্ড পেতেন দূর্বলেরা। এখন দন্ড পায় অপরাধীরা। আগে তার বেতনভুক্ত ক্যাডারেরা সম্মান দেখাতো, এখন গ্রামের প্রায় সবাই-ই তাকে সম্মান করে।

আগে তিনি মানুষের মাঝে বিবাদ লাগিয়ে দিয়ে, দু’পক্ষের কাছেই নিজের আধিপত্য রাখতেন ও সুবিধা আদায় করতেন। কিন্ত এখন প্রয়োজনে নিজের কাছ থেকে অর্থ-সম্পত্তি অন্যকে দিয়ে বিবাদ মেটান, সকলের শান্তির জন্য, কল্যাণার্থে।

এই পরিবর্তীত মানুষটির নাম রাঘব রায়। এলাকার নির্বাচিত চেয়ারম্যান । যখন নির্বাচিত হয়েছিলেন তখন অবশ্য জনগণের ভোটে হন নাই, হয়েছিলেন টাকা ও অস্ত্রের জোরে। তখন তার অনেক ব্যবসা-ই ছিল। এদের মধ্যে টিকাদারি ছিল মূখ্য ব্যবসা। এছাড়াও কিছু গোপন ব্যবসা ছিল, যার কিছু-ই এখন আর নেই। তিনি স্বেচ্ছায়-ই সব বাদ দিয়েছেন। এবং যারা এদের সাথে জড়িত ছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে ও আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছেন।

রাঘব রায় এখন গ্রামে আলোচিত এক ব্যক্তি ও সাধারণ মানুষের বন্ধু। আগে তার জীবনের নিরাপত্তার জন্য, অনেক প্রহরী ছিল । এখন তিনি একাকী জীবন যাপনেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এমনকি তার গৃহের কাজও, তিনি একাই করতে পছন্দ করেন।

একমাত্র ছেলে, রনজিত রায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে। প্রকান্ড এক বাড়িতে থাকেন রাঘব রায়, তার স্ত্রী ও একমাত্র মেয়ে রমা রায়। বাবার এমন পরিবর্তণে রনজিত ও রমা রায় উভয়ই গর্বিত। কিন্ত মানুষের কাছে এটা এক বিস্ময় ও রহস্য।

আমাদের দেশে ভাল মানুষ ও ভাল কাজের সম্মান ও ভালবাসা থাকলেও , পাশাপাশি রাগ-বিদ্বেষ ও থাকে। এই রাগ-বিদ্বেষ ভাল মানুষদের প্রতি খারাপ মানুষদের। যে মানুষটি সাধারণ মানুষদের ভাল করতে খারাপ মানুষদের খারাপ কাজে বাধা, সেই মানুষটি খারাপ মানুষদের শত্রু। চির শত্রু।

রাঘব রায়ও এখন কিছু কিছু খারাপ লোকেদের চির শত্রু। আগে যে সব লোক তার বন্ধু ছিল, এখন তারা শত্রু। আগে যে সব লোক তাকে, বাঁচাতে চাইতো, এখন তারা সবাই রাঘব রায়কে মারতে চায়, হত্যা করতে চায়।

রাঘব রায়কে মেরে ফেলার পরিকল্পনা অটুট। লোক ভাড়া করা হল। যাকে ভাড়া করা হল, সে আগে রাঘব রায়ের-ই বডিগার্ড ছিল। তার নাম নরেশ।

ইতিহাস সাক্ষ্য। এ পৃথিবীতে বেশিরভাগ নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিদেরকে হত্যা করেছে, তাদেরই বিশ্বস্ত কেউ না কেউ। নরেশ ও তেমনই একজন একসময়ের বিশ্বস্ত বডিগার্ড। কিন্ত এখন হতে চলছে তার-ই খুনি।

পার্ট-২

মাঝ রাত। রাঘব রায় ঘুমিয়ে পড়েছে। হঠাৎ, বাড়ীর গেটের ওপ্রান্তে থেকে কে যেনো ডাকছে।

– কাহা, ও কাহা। ঘুমাইয়ে গেছেন নাহি?

ঘুম ঘোরে রাঘব রায় প্রথমে কন্ঠটি বুঝতে পারেনি। পরে অবশ্য চিনতে কোনই কষ্ট হল না। এত কাল যে তার সাথে সাথে ছিল, তাকে পাহারা দিয়েছে। আর তার কন্ঠ চিনবে না? তবে কন্ঠটি চিনলেও, ডাকার স্বর ও এত রাতে ডাকার উদ্দ্যেশ্যটা ছিল সম্পূর্ণ অপরিচিত। তবুও বুঝে নিল।

ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলছে,

-কে? নরেশ

– হ, কাহা।

রাঘব রায় আর কোন প্রশ্ন করলো না। সোজা গিয়ে বাড়ির প্রধাণ গেইটটা খুলে দিল। তবে নরেশের চোখের ভাষাটা ছিল ভিন্ন। এই ভাষা রাঘব রায় বুঝেছে কিনা জানি না, তবে উনি এতে মোটেই বিচলিত হন নাই। বরং, নরেশকে সাদরে বাড়িতে আসতে আমন্ত্রণ জানালেন। কিন্ত নরেশ বলছে,

– না, কাহা ভিতরে যা্মু না, আপনি একটু বাইরে আহেন। একটু কথা কয়েই আমি চইলা যামু ।

– নরেশ, তোর কোমরে যে মেশিন রয়েছে, ওটা কিন্ত এক সময় আমিই তোকে দিয়েছিলাম। আমি এখন এসবের মধ্যে নেই, তার মানে এই নয় যে, আমি বুঝাটাও বাদ দিয়েছি। ভেতরে আয়, আমাকে মারার আগে অন্তত আমার পরিবর্তণ হবার কারণটা জেনে নে।

নরেশ স্তব্ধ হয়ে গেল। কিছুই আর বলতে পারলো না। রাঘব রায় নরেশকে বাড়ীর ভেতরে গেস্ট রুমে নিয়ে গেল। তারপর বলল,

– নরেশ, তোর মা ভাল আছে?

-হ, কাহা , ভালাই আছে।

– তোর বাবার কথা মনে পড়ে?

নরেশ চুপ করে রইল।

– আচ্ছা, আমি আর কথা বাড়াবো না। আমার পরিবর্তণ হবার কারণটা তোকে জানাবো। এটা জেনে , তুই এখানেই আমাকে গুলি করে, এই দরজা দিয়ে বের হয়ে ঐ গেট খোলা-ই আছে । তুই সোজা চলে যাবি। তোকে কেউ কিছুই বলবে না। এমনকি ধরবেও না।

রাঘব রায় তার হঠাৎ পরিবর্তণ হবার কারণ শুনালেন। এরপর নরেশের দিকে না তাকিয়েই বললেন, এখন তুই আমাকে মারতে পারিস। এটা বলে যখনই নরেশের দিকে তাকালেন, দেখলেন নরেশের চোখ দিয়ে জল ঝড়ে পড়ছে।

ওমনি হাও মাও করে কাঁদতে কাঁদতে রাঘব রায়ের পা-জড়িয়ে ধরে বলল,

– কাহা, আমারে মাফ কইরা দেন। আমি কথা দিতাছি, আমিও ভাল হইয়া যামু।

আমরা ও আমাদের জীবনের আয়ুরেখার সীমাটা যদি জানতাম, তাহলে হয়তো আমরাও আর শুধু নিজেদের কথা ভাবতাম না

পার্ট-৩

নরেশেরও ভেতর থেকে নাড়া দিল, ভাল হয়ে গেল। কিন্ত, জীবিকা? রাঘব রায়-ই নরেশের দায়িত্ব নিল। নরেশ রাঘব রায়ের বাড়ি ও জমিজমা দেখাশোনা করবে। বিনিময়ে পারিশ্রমিক পাবে৷

নরেশের এমন পরিবর্তণটাও সবার কাছে কৌতূহলের বিষয় হয়ে দাড়াল। যাই হোক, রাঘব রায়ের একটাই সিদ্ধান্ত যতদিন বাচবে, মানুষের জন্য কাজ করে যাবে।

রাঘব রায় একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিবে। এই সিদ্ধান্ত নেবার জন্য তার ছেলে ও মেয়ের সাথে কথা বলা আবশ্যক। তাই, ছেলে রনজিত রায়কে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাড়িতে আসতে বলল।

রনজিত রায়, রাষ্টবিজ্ঞাণের ৪র্থ বর্ষের ছাত্র। ছাত্র খুব যে মেধাবী এমন না। তবে নিজের ভবিষৎ সম্পর্কে খুবই সচেতন। ওদের পাশের গ্রামের হারাধন রায়ের একমাত্র মেয়ে, উমা রায়ের সাথে ওর খুব ভাব। কিন্ত গ্রামের লোক এ সবের কিছুই জানে না। ওরা একই সাথে পড়ালেখা করছে। প্রথম দিকে রাঘব রায়ের অসততার কারনে, উমা রায় রনজিৎকে মেনে নিতে পারে নাই। এখন অবশ্য দু’জনই দুজনকে খুব ভালবাসে।

পরের দিন, রনজিত বাসায় আসলো। রাতে পারিবারিক মিটিং। পারিবারিক মিটিং হলেও, এ মিটিং এ নরেশও উপস্থিত৷ নরেশ রাঘব রায়ের খুবই বিশ্বস্থ ও পরিবারের একজন সদস্যের মতই৷

মিটিং শুরু,রাঘব রায় বলতে শুরু করলো,

-আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এলাকায় একটা স্কুল দিব৷ এই স্কুল কোন নির্দিষ্ট ক্লাসের না। ছোট, বড় সবাই-ই এই স্কুলের শিক্ষার্থী। তবে, অবশ্যই পৃথক পৃথক ভাবে৷ নৈতিক ও মানবিক শিক্ষা দানই এই স্কুলের প্রধাণ ও প্রতিপাদ্য বিষয়। এই স্কুলের মাধ্যমে গরীব-দুস্থ যারা অর্থের অভাবে খারাপ পথে যেতে বাধ্য হয়,তাদের সাহায্য করা হবে।ভাল মানুষদের ভাল কাজের জন্য পুরস্কৃত করা হবে।এই উদ্দ্যেশে আমি আমার স্থাবর সম্পত্তির চার ভাগের দুই ভাগ বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বাকি দুই ভাগ তোমাদের দুই ভাই-বোনদের জন্য।

-কিন্ত বাবা,,,,,?

রনজিত রায়ের ‘কিন্ত’ প্রশ্ন শুনে রাঘব রায় একটু বিস্ময়ের চোখে ওর দিকে তাকালেন। কারণ উনি ভেবেছিলেন এই সিদ্ধান্ত শুনে ছেলে-মেয়ে উভয়ই খুব খুশি হবে। কারণ, পূর্বে অনেক বারই রনজিত ও রমা তাকে ভাল হয়ে যাবার জন্য অনুরোধ করেছিল।

– আবার কিন্ত কি? এটা তো খুবই ভাল সিদ্ধান্ত, বাবা

ও পাশ থেকে রমা রায় হাসি মুখে বলে উঠল।

রনজিত উদ্বিগ্নতার স্বরে বলল,

– কিন্ত, আমাদের ভবিষৎ???

রাঘব রায় আর রনজিত রায়ের ‘কিন্ত’র দিকে কান দিলেন না। তার স্থাবর-অস্থাবরের অর্ধেকাংশ বিক্রি ও স্কুল স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন।

পার্ট-৪

জমি বিক্রির বন্দোবস্ত হয়ে গেছে। এ দিকে নরেশের মা অসুস্থ। কয়েকদিন হল নরেশ রাঘব রায়ের বাড়িতে আসছে না। কিন্ত নরেশকে ছাড়া রাঘব রায় জমি বিক্রির টাকা আনতে যাবে না। এমনকি স্কুল স্থাপনের কাজও শুরু করবে না।

এ সব কিছুই রনজিতের কাছে একটু বেশিই বাড়াবাড়ি মনে হয়। জীবন দর্শণ ব্যক্তিভেদে ভিন্নতর। এই যেমন, রনজিতের কাছে ‘ভাল মানুষ’ আর রাঘব রায়ের কাছে ‘ভাল মানুষ’এক নয়।

রনজিতের কাছে ভাল মানুষ হওয়ার অর্থ এই যে, সবাই ভাল মানুষ হিসাবে জানবে ও সম্মান করবে। এতে যদি কেউ কষ্ট পায় বা কারোর ক্ষতি হয়, তবুও ঠিক আছে।

কিন্ত রাঘব রায়ের উপলব্ধিতে ভাল মানুষ হল, কে কি ভাবলো বা সম্মান-অসম্মান করলো এতে উদ্বিগ্ন হবার কিছুই নেই। নিজের কাছে নিজে ভাল হতে হবে। আর এই নিজের কাছে নিজে ভাল হতে হলে কাউকে কষ্ট দেওয়া যাবে না, কাউকে ক্ষতি করা যাবে না ও অন্যদের ভাল রাখতে হবে। অন্যদের ভাল রাখা ও ভাল করার মধ্যেই নিজের ভাল থাকা খুজে নেওয়াটাই ভাল মানুষের বৈশিষ্ঠ্য।

হঠাৎ নরেশ চলে আসলো। এসেই রাঘব রায়ের উদ্দ্যেশ্যে বলছে,

– কাহা, কয়দিন ধরে মা’ডার খুব অসুখ। ভালা একটা ডাক্তার দেহান লাগতো।

– বেশ তো, দেখাবি। তা আজই দেখাবি কি?

– না, কাইল, দেহাবুনে।

– বেশ, তাহলে চল। জমি বিক্রির টাকা গুলো আনতে হবে। ওখান থেকে তোর মায়ের চিকিৎসার জন্যও কিছু টাকা রেখে দিস।

– না কাহা, ঐখান থেকে আমি কোন টাকা নিব না।

– আরে বোকা, টাকা তো টাকাই।

– তারপরও,,,,,,

– আচ্ছা, আগে চল।

রাঘব রায়, রনজিত ও নরেশ চলল জমি বিক্রির টাকা আনতে। টাকা নিয়ে দুপুরের দিকে তিন জন এক সাথেই বাড়ি ফিরলো।

রাঘব রায় টাকাগুলো আলমারীতে তুলে রাখার সময় নরেশকে কিছু টাকা দিয়ে বলছে,

– কাল তোর মাকে ভাল একটা ডাক্তার দেখাবি

– না, কাহা, এহান তেন আমি কোন টাহা নিতে পারুম না। আমারে মাফ কইরেন। এই টাহা আমাগো এলাকার লোকদের ভালা মানুষ হয়োনের লাইগা। আমারে মাফ কইরেন।

– কিন্ত, আমার কাছে যে এখন আর টাকা নেই। মাছের খামারের ওখান থেকে মাছ বিক্রির কিছু টাকা সন্ধ্যার সময় পাব। তাহলে তুই একবার রাতের দিকে এসে টাকাটা নিয়ে যাস৷

– আচ্ছা কাহা, আমি তাহলে এহন যাই।

সন্ধ্যার দিকে রাঘব রায় মাছের খামারে গেল টাকা আনতে। নরেশকে রাঘব রায় পুত্রসুলভই স্নেহ করে। সেই ছোট বেলায় বাবাকে হারিয়ে মায়ের অন্ধের যষ্টি নরেশ। রাঘব রায় নরেশকে নিয়ে ভাবছে,

“যখন খারাপ ছিলাম তখন নরেশ পাশে ছিল। এখনো ও আমার পাশেই আছে। ওর জন্য আমার অবশ্যই কিছু করা উচিৎ।”

ভাবতে ভাবতে বাড়িতে চলে আসলো। বাড়িতে এসে রুমে ঢুকতেই দেখে আলমারিটা ভাঙ্গা।

আলমারিটার কাছে আসতেই রাঘব রায়ের মাথায় যেন আকাশ ভেংগে পড়ল। আলমারিতে রাখা একটা টাকাও নেই,,,,,,,,,,

উপলব্ধি

পার্ট-৫,

আলমারিতে রাখা টাকা নেই, আবার অন্য দিকে নরেশ ও নরেশের অসুস্থ মাকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। একটা সন্দেহ, একটা শংকার তীর যেন এসে বিধছে রাঘব রায়ের বুকে। টাকা হারানোর জন্য না, স্বপ্ন ভাঙ্গার জন্যও না, কেবলই বিশ্ব্বাস ভাঙ্গার জন্য।

ইতোমধ্যে রনজিত পুলিশকে খবর দিয়েছে। পুলিশ চারিদিকে নরেশকে খুঁজছে। কিন্ত রাঘব রায় স্বস্তি পাচ্ছেন না। বুকের ভেতরে সেই পুরোনো ব্যাথাটা চিন চিন করছে। অনুভব করতেই কেমন যেন শরীর ঘামতে শুরু করলো রাঘব রায়ের।

ব্যথাটা খুব চেনা কিন্ত এবারের মাত্রাটা একেবারেই অচেনা। রাঘব রায়ের বুঝার আর বাকি রইল না যে, তার সময় শেষের দিকে।

এর আগে এই একই ব্যাথায় জেলা শহরের বড় এক ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন। বেশ কিছু দিন ধরে অনেক চেকআপ ও বিভিন্ন টেস্ট করেছিলেন। এরপর থেকেই রাঘব রায়ের আমূল পরিবর্তন। কারণ, ডাক্তার অসুস্থতার তীব্রতা ব্যাখ্যা করে তার জীবনের আয়ূকে আনুমানিক সময় সীমারেখায় বেধে দিয়েছিল।

রাঘব রায়ের উপলব্ধি আসে এই বাধাধরা আয়ূরেখা থেকেই। কিন্ত এর মাঝে মানুষের ভালবাসা, সম্মান ও মায়া ছেড়ে যাওয়াটা সত্যই খুবই কষ্টকর।

আমরা ও আমাদের জীবনের আয়ুরেখার সীমাটা যদি জানতাম, তাহলে হয়তো আমরাও আর শুধু নিজেদের কথা ভাবতাম না।

যাই হোক, এই সীমাবদ্ধ আয়ুরেখার কথা শুনে নরেশের চোখেও জল এসেছিল। কিন্ত সেই নরেশ! না, রাঘব রায় কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। বিশ্বাস ও করতে পারছে না।

-নরেশ এ কাজ করতে পারে না।

অস্পষ্ঠভাবে বলতে বলতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। রনজিত দ্রুত ডাক্তার ডাকতে যেতে চাইলে রাঘব রায় বাধা দিল৷ হাও মাও করে রমা রায় ও তার মা কাদতে শুরু করলো। ইতোমধ্যে পাশের বাড়ির প্রতিবেশিরা আসতে শুরু করেছে।

রাঘব রায় শুধু অস্পষ্টভাবে বলে যাচ্ছে

– নরেশ চুরি করতে পারে না। নরেশ চুরি করতে পারে না।

কিছু সময় পর স্তব্ধ আর সবার কান্নার ঢল।

পার্ট-৬

কয়েক বছর পর,,,,,,

রনজিত বাবার স্বপ্নপূরণে স্কুল স্থাপন করেছে। রনজিত তার ব্যক্তি জীবনে সবচেয়ে বেশি যা ঘৃণা করে তা হল, ১. মিথ্যা ৩. চুরি।

গ্রামের মানুষ রাঘব রায়কে আজো অনেক ভালবাসে ও সম্মান করে। তার মৃত্যুর জন্য সবাই নরেশকেই দায়ি করে। রাঘব রায়ের কথা উঠলেই সাথে সাথে নরেশের কথাও উঠে। একজনের প্রতি সম্মান ও আরেকজনের প্রতি ঘৃণা। সবাই নরেশকে রাঘব রায়ের হত্যাকারী হিসাবেই মেনে নিয়েছে।

রনজিৎ এ সব শোনে আর একটা অপরাধবোধে ভোগে। অনুশোচনায় আহত হয়। যখনই মানুষের কাছ থেকে শুনে, নরেশ হত্যাকারী। তখনই ভেতরে ভেতরে খুনি ও খুন ও নিজেই হয়।

আজ রনজিতকে সবাই সম্মান করে, ভাল মানুষ হিসাবে জানে। কিন্ত ও নিজের কাছে নিজে বড্ড বড় অপরাধী, খুনি। নিজের বাবার খুনি।

ও মাঝে মাঝেই ইচ্ছে করে সবাইকেই জানিয়ে দিতে যে,

নরেশ না। টাকাটা আমি চুরি করেছিলাম। আমার বাবার মৃত্যুর জন্য, নরেশ না। আমিই দায়ি। বরংং নরেশ , চুরি করার দৃশ্য দেখে ও নিজেই দায় ভার নিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে। স্বয়ং আমি এই কাজ করছি, এই কথা বাবা সহ্য করতে পারবে না ভেবে। ও চোর না, ও মহৎ,,,,,,

কিন্তু, কাউকেই জানাতে পারে না।

রনজিত একসময় যেমনটা চেয়েছিল, তেমনটাই হয়েছে। সবার কাছে এখন ওর অনেক সম্মান, অনেক কদর। সমস্ত দায়ভার নরেশের উপর চেপেছে। কিন্ত ওর নিজের কাছে নিজে ???

মানুষ সব কিছু থেকে পালাতে পারে, কিন্ত নিজের কাছ থেকে নিজে পালাতে পারে কি?

যাই হোক, নরেশ কে আর কোনদিনই খুজে পাওয়া যায়নি। আর রনজিতের সম্মানই বড় বেশি অসম্মান হয়ে রইল।